পিরামিডের দেশে দশ ঘণ্টা
ছাত্রাবস্থায় হোটেল ম্যানেজম্যান্ট পড়তে ভূমধ্যসাগরীয় পর্যটন দ্বীপ সাইপ্রাস গিয়েছিলাম। সেই সময়ে সামারের ছুটিতে বাংলাদেশী বন্ধুরা মনে মনে ভাবছিলাম কি করা যায়। ভাবতে ভাবতে হটাৎই মাথায় এলো যে, পিরামিডের দেশ ‘মিশর’ ভ্রমণের। পত্রিকায় দেখলাম সাইপ্রাসের লিমাসল বন্দর থেকে বেশ ক‘টি জাহাজ প্রতিদিন মিশরের পোর্ট সাঈদ, ইসরাইল এবং গ্রীসের ক্রীক দ্বীপে পর্যটকদের নিয়ে যাচ্ছে। কৌতূহলবশত দেখলাম প্যাকেজ মূল্যও খুব বেশী নয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পিরামিডের দেশ ‘মিশর’-এ যাবো। চীনা দুজন বন্ধুদের বলতেই ওরা মহাখুশি এবং আমাদের সাথে যেতে চাইলো। যথারীতি নিকোশিয়ায় অবস্থিত ‘প্রিন্সেস সিপ্রিয়া’-এর সেলস্ অফিসে যোগাযোগ করলাম। বাংলাদেশের আমরা ৫ জন এবং চীনা ২ জন মোট ৭ জন যাবো মিশরে। বুকিং দিয়েই ছুটলাম সাইপ্রাসে অবস্থিত মিশরের দূতাবাসে ভিসা সংগ্রহ করতে। মুসলমান হওয়াতে ভিসা পেতে কোনো সমস্যাই হলো না। আমাদের চোখে-মুখে সে কি আনন্দ। নতুন দেশ জয়ের আনন্দে বিভোর সবাই। যথারীতি একদিন সবাই লিমাসলে অবস্থিত ‘প্রিন্সেস সিপ্রিয়া’ জাহাজে চেপে বসলাম।ঠিক বিকেল পাঁচটায় সাইপ্রাসের লিমাসল বন্দর থেকে জাহাজ ছেড়ে দিলো মিশরের পোর্ট সাঈদের উদ্দেশ্যে। এর আগে জাহাজে ঢুকেই ভ্রাম্যমাণ ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের মুখোমুখি হলাম সবাই। দুটো ছোট টেবিল নিয়ে বসেছে সবাই। আমাদের পাসপোর্ট এবং ভিসা দেখে এন্ট্রি সিল মেরে দিলেন তাঁরা। জাহাজে ডুকতেই প্রিন্সেস সিপ্রিয়ার লোকজন আমাদের স্বাগত জানালো। পাঁচ তলা বিশিষ্ট বিশাল জাহাজ এই প্রিন্সেস সিপ্রিয়া । আমরা হচ্ছি, সবচেয়ে ইকোনমী ক্লাসের যাত্রী- অনেকটা ঢাকা-বরিশাল রুটের ডেকের মত। পার্থক্য শুধু এই যে, আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব আসন রয়েছে এবং পুরো জাহাজই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। লিফটে চড়ে উপরে ৪র্থ তলায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। যার যার ব্যাগ যথাস্থানে রেখে উপরে ছাদে চলে এলাম আমরা জাহাজ পরিদর্শনে। কি নেই জাহাজে। সুইমিং পুল, ইনডোর গেমস, বার,ড্যান্স ফ্লোর, দুটো বড় রেস্তোরা, সারি সারি কেবিন টাইটনিকের মিনিয়েচার সংষ্করণ আর কি। যদিও মোট ৫০০ যাত্রী ধারণ ক্ষমতা এই জাহাজটির। ঠিক পাঁচটায় জাহাজ ছেড়ে দিলো। ভুুমধ্যসাগর দিয়ে জাহাজ তরতর করে বয়ে চললো নীল নদের দেশে। আমরাও জাহাজের ছাদে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম।
এভাবেই সন্ধ্যা হয়ে গেলো। এবার আমরা ইনডোর গেমস্-এর কক্ষে প্রবেশ করলাম। বিলিয়ার্ড,টেবিল টেনিস, তাস সবই আছে ওখানে, আমরা গিয়ে টেবিল টেনিস খেলায় মত্ত হলাম। দেশে থাকতেই টেবিল টেনিস খেলায় কিঞ্চিৎ পারদর্শী ছিলাম। তাই ওখানে ভেড়ার পালে বাছুর সর্দার হয়ে গেলাম। বাকী সবারই বোধহয় সেদিনই টেবিল টেনিসে হাতেখড়ি। কেউ টেনিস বল ব্যাডমিন্টনের মত করে মারছে কেউবা ক্রিকেটীয় ভঙ্গিতে সরাসরি ছয় মেরে বল মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কেউবা টেবিল টেনিস ছেড়ে বিলিয়ার্ডে গভীর মনোনিবেশ করেছে। তাঁদের খেলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, যেন কতদিনের পুরনো খেলোয়াড় তাঁরা। খুবই মনোযোগ দিয়ে বলে মারছে কিন্তু আঘাত করছে অন্য বলে।আর এসব নিয়ে সেকি হাসাহাসি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখানে উপস্থিত জনাকয়েক বিদেশী খেলার প্রতি আমাদের একাগ্রতা, নিষ্ঠা এবং নৈপুণ্য দেখে পরাজয় মেনে নিয়ে চলে গেলেন। এবার আমাদের পায় কে। পুরো ইনডোর গেমস রুম জুড়েই আমাদের জয় জয়াকার। সন্ধ্যের ঠিক আগে আগেই উপরের ডেকের এক কোণায় প্রচুর কৌত‚হলী মানুষদের ভীড় লক্ষ্য করলাম। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই এ এক অপূর্ব দৃশ্য। আমাদের জাহাজ থেকে ১০-১২ ফুট দূরে সমান্তরালভাবে বিশাল এক হাঙরের ঝাঁক। ডুব দিচ্ছে, পরক্ষণেই আবার ভেসে উঠছে। কিন্তু চলছে জাহাজ পথ ধরেই সমান্তরালভাবে। এ দৃশ্য সত্যিই ভুলবার নয়। দৌড়ে ক্যামেরা নিয়ে আসলাম রুম থেকে ছবি তোলার জন্যে। কিন্তু ততক্ষণে ওদের খেলা শেষ। আর দেখিনি ওদের।
যথারীতি রাতের খাবারের সময় হলো, আমাদের সবাইকে জাহাজের রেস্টুরেন্ট যেতে বলা হলো। রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই অবাক হবার পালা। বিশাল বড় রেস্টুরেন্ট। প্রায় ৬০০ জন লোকের একসাথে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা সবাই এক টেবিলেই বসলাম। পুরো রেস্টুরেন্টে আমরাই শুধু ৫ জন বাঙালী আর সব শ্বেত চামড়ার মানুষজন। এটু পরেই একজন ওয়েটার এসে মেন্যু দেখিয়ে কি খেতে চাই জিজ্ঞেস করলো। আমাদের চেহারা দেখেই ওঁ বলে উঠলো, ‘Are you Muslim?’ হ্যা বলতেই ওঁ বললো, ‘কোনো অসুবিধা নেই। আমি হালাল খাবার নিয়ে আসছি ।’ বলেই চলে গেলো মিশরীয় ওয়েটার। একটু পরেই আমাদের আহারযোগ্য খাবার নিয়ে এলেন তিনি। একটু অবাকই হলাম। এই জাতীয় জাহাজে এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কীভাবে তাঁরা যথাযথ সেবা দিয়ে দিয়ে আসছে পর্যটকদের। এজন্যই বোধকরি প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিশর পর্যটকদের কাছে এত জনপ্রিয় এবং পছন্দের স্থান। খাবার দাবার শেষ করে আরেক বিপদ। আমরা হচ্ছি জাহাজের সবচেয়ে সস্তা টিকিটের যাত্রী অর্থাৎ ডেকের যাত্রী বলা যেতে পারে। ফলে আমাদের জন্যে নির্ধারিত আসনে ঘুমোবার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু এভাবে কি আর বঙ্গসন্তানদের ঘুম হয়। দেখি সবারই একই অবস্থা। পরে সকলের সিদ্ধান্তনুযায়ী কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে একটি দ্বৈত আসনের কেবিন ভাড়া করলাম। ব্যস, হুড়মুড়িয়ে সবাই গিয়ে ঢুকলাম কেবিনে। দ্বৈত আসনের কেবিনে আমরা ৫জন। সে এক দৃশ্য বটে। কেউ মাটিতে, কেউ বিছানায়, কেউবা একজনের উপরেই শুয়ে পড়েছে। যা হোক, এভাবেই কেটে গেলো সমস্ত রাত।
পরদিন সকাল ৬:৪৫ মিনিটে বিখ্যাত নীলনদ পেরিয়ে আমরা পৌছে গেলাম মিশরের পোর্ট সাঈদ-এ। মিশরীয় ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসের ঝামেলা শেষে জাহাজ থেকে বেরুতে গিয়ে দেখলাম ফুটপাথের দুপাশে রকমারি জিনিসপত্রের পশরা নিয়ে বসে আছে দোকানিরা। ব্যাগ, সুকেস থেকে শুরু করে রকমারি তৈজসপত্র পর্যন্ত। তাদের জিনিসপত্রের সাজানোর ধরন এবং হাঁকডাক দেখে ঢাকার জিপিও, রমনা ভবন আর গুলিস্থানের সামনের ফুটপাথের কথা মনে পড়ে গেলো। ভাষাগত বৈষম্য ছাড়া একবারে মিরে যাচ্ছে সবকিছু।। ভীড় ঠেলে আমরা গিয়ে উঠলাম, আমাদের জন্যে সংরক্ষিত বাসে। বাস ছুঠে চললো রাজধানী কায়রো তথা পিরামিডের উদ্দেশ্যে। একজন গাইড বাসে বসে বসে আশেপাশের সবকিছুর বর্ণনা দিচ্ছিলেন। পিরামিড যাবার প্রাক্কালে আমরা কিছুটা সময় কাটালাম মিশর যাদুঘরে। এ এক বিশাল যাদুঘর। এইখানে এসে আমরা ৫ গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়লাম। কারণ এতবড় যাদুঘর একসঙ্গে সবাই দেখা সম্ভব নয়। গাইডকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম যাদুঘরের অভ্যন্তরে। মূল্যবান স্বর্ণখচিত আসবাবপত্রই প্রথমে নজরে পড়লো। সোনার স্যান্ডেলও দেখলাম অনেকটা আমাদের দেশের কোলাপুরীর মতো। এছাড়াও বেশকিছু সোনার মমি দেখলাম। দেখলাম, কি করে মমি তৈরি হয়। যাদুঘরে প্রায় এক ঘন্টার মত কাটিয়ে আমরা আবার চল্লাম পিরামিডের উদ্দেশ্যে। এরমাঝে বাসে আমাদের দেয়া হলো উটে চড়ার জন্যে নির্দিষ্ট টিকেট। ঠিক একঘন্টা পর বাস গিয়ে পৌছালো গন্তব্যে। আর মাত্র ১০০ গজ সামনে গেলেই পিরামিড। ভাবতেও শিহরিত হয়ে উঠছিলাম বারবার। টিকেট দেখিয়ে যথারীতি উটের পিঠে চড়তেই উট এগিয়ে চললো পিরামিডের উদ্দেশ্যে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম চিওপ্স পিরামিডের পাদদেশে। এটাই সর্ববৃহৎ পিরামিড। এক লক্ষ লোক দৈনিক দুবেলা কাজ করে ১০ বছরে এর নির্মাণ কাজ শেষ করেছে বরে জানা গেছে। এটি উচ্চতায় ৯২৩.৫ মিটার। এর দুপাশে আর দুটো পিরামিড রয়েছে। একটার নাম চেফ্বেন এবং অন্যটি মিসিরিনিওস। উচ্চতায় চিওপ্স-এর চেয়ে কিছুটা কম হলেও সৌন্দর্যে কোনো অংশে কম নয়। প্রতিটি পিরামিডেরই ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ওখানে নামতেই গা শিউরে ওঠার মতো অবস্থা। তীব্র কনকনে ঠান্ডা।
এবার গন্তব্য ‘স্ফিংস’। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ‘স্ফিংস’-এর দ্বারপ্রান্তে। চারদিকে লোহার রড দিয়ে বেষ্টিত ‘স্ফিংস’। কাছে যাবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু বাধ সাধলেন কর্তৃপক্ষ। একবারে কাছে যাবার অনুমতি নেই। কারণ কিছুদিন আগেই ‘স্ফিংস’- এর ঘাড়ের কাছ থেকে বড় একটি পাথর সরে গেছে। তাই সম্ভাব্য যে কোনো দূর্ঘটনা এড়াতে কর্তৃপক্ষের এই অতি সতর্কতা। অগত্যা দশ-বারো হাত দূর থেকেই দেখতে হলো ‘স্ফিংস কে। চেহারাটা মলিন মনে হলো। পরে জানলাম, বয়সের ভারে ন্যুজ স্ফিংসে ফাটল ধরেছে।বেশ কিছু ছবি তুললাম স্ফিংসকে পেছনে রেখে। এর মাঝেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ফেরার সময় হয়ে গেলো। যথারীতি বাসে গিয়ে উঠলাম আমরা।
তবে একটি বিষয় লক্ষ্য করে খুবই দুঃখ পেলাম। আর তা হলো, পিরামিড সংরক্ষণের আন্তরিক উদ্যোগের অভাব।স্থানে স্থানে খসে পড়ছে পাথর। বেশ কিছু ছোটখাটো পিরামিড তো ইতিমধ্যেই ধসে পড়ে গেছে।কিন্তু সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। কে জানে, হয়তো আগামী ১৫-২০ বছর পরে কোনো অস্তিত্বই থাকবে না পিরামিডের। আমরা পিরামিডে পৌঁছতেই ছেঁকে ধরলো ভিক্ষুকের দল। পয়সা না দিয়ে পার পাওয়া কঠিন। একবারে নাছোড়বান্দা। অনেকটা আমাদের ঢাকা শহরের ভিক্ষুকদের মতোই। আবার ১৫-২০ সেন্ট দিলেও বিপদ। নিতে চাইবে না , না হয় ভর্ৎসনা করবে আপনাকে। এতাগেলো এক রকমের অভিজ্ঞতা। আর একটি বিষয় খুবই অবাক করেছে আমাদের। আর তা হলো , রাজধানী কায়রো শহরে ঢাকার মতো একটাও লেটেস্ট মডেলের গাড়ি চোখে পড়েনি আমার। সব গাড়িরই জীর্ণশীর্ণ দশা। একটা মাত্রমার্সিডিজ বেঞ্চ দেখলাম- তাও বহু পুরোনো মডেলের। এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে দশটি ঘন্টা। সঞ্চিত হয়েছে এমন কিছু -যা শুধু নিজে নিজেই অনুভব করছি। এ অনুভুতি জীবনে কখনোই ভোলার নয়।
আবার কখনো পিরামিডের দেশে আসা হবে কিনা জানি না। তবে অভিজ্ঞতা কখনোই ভুলবার নয়। জীবনে যখনই যে অবস্থায়ই থাকি না কেন, ‘স্ফিংস’-এর কথা অন্তত মনে থাকবে চিরকাল। আমার বৃদ্ধ অসহায় বন্ধু স্ফিংস এখন কেমন আছে? হয়তো বা শতাব্দীর পর শতাব্দী জীবিত থাকার পর এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে সে। আর অভিশাপ দিচ্ছে সমগ্র মনুষ্য জাতিকে- যারা শুধুই অর্জন করে গেলো ওঁকে ঘিরে, কোনো কিছু বর্জন করলো না ওঁর জন্যে।