বাজেটে পর্যটন খাত নিয়ে ভাবনা
বাজেটের সময় এলে সব ব্যবসায়ী তৎপর হয়ে ওঠেন তাঁরা বাজেট থেকে কী কী সুবিধা পেতে পারেন। শুরু হয় দেনদরবার। কারা কী সুবিধা নিতে পারেন তাঁদের শিল্পের জন্য। পর্যটন একটি শিল্প। সরকার স্বীকার করে, কিন্তু মানে না। ফলে শবেবরাতের রাতের মতো সব বান্দা যেমন হাত পাতেন, কিন্তু সবার ভাগ্য পরিবর্তন হয় না, তেমনি হলো পর্যটনের দশা।
পর্যটন একটি শিল্প, কোনো রঙ্গমঞ্চ নয়। আনন্দ-ফুর্তি আর নাচে-গানে ভরপুর। সরকার যে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে মানে না, বাজেটে বরাদ্দ দেখলে তা স্পষ্টত বোঝা যায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, শুধু ভ্রমণ কর থেকে সরকার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা উপার্জন করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ছিল। পরবর্তী অর্থবছরে তাই ভ্রমণ কর আরো বৃদ্ধি পেল।
অথচ সরকার পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন, বিকাশ ও বাজারজাতকরণে যে মনোনিবেশ প্রয়োজন, সেদিকে তা দেয়নি। কভিড-পরবর্তী সময়ে সব দেশ ও জাতি এই শিল্পের মাহাত্ম্য অনুধাবন করে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি পাকিস্তান, যারা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পশ্চাৎপদ ছিল, তারাও আজ পর্যটনে বাংলাদেশকে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। শুধু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত পর্যটনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি বহুগুণ বৃদ্ধি করে। কভিড-পূর্বে, পাকিস্তানে পর্যটকের আগমন ছিল মাত্র তিন লাখ। গত বছর সেই সংখ্যা ১০ লাখের কাছাকাছি ঠেকেছে। নেপাল সাড়ে ১১ লাখ আর শ্রীলঙ্কা ২০ লাখ অতিক্রম করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলো পর্যটনের মাহাত্ম্য অনুভব করে। ফলে তারা সবাই পর্যটনের ফসল তুলতে পেরেছে। বাংলাদেশ এখন সবার পেছনে।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প একটি অগ্রাধিকার শিল্প, যা বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ। পর্যটনশিল্প একটি বহুমুখী শিল্প। বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। লাল ফিতায় একে বেঁধে রাখা যাবে না। লাল, নীল, সবুজ অনেক ফিতার সমন্বয় পর্যটনশিল্প। এই শিল্প অন্যান্য শিল্পের পরিপূরক। পর্যটন এমন একটি শিল্প, যা নানা সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের সাহায্যে এবং সমাজের সবার সহযোগিতায় বেড়ে ওঠে। একই সঙ্গে অনেকের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাহায্য করে। আমলাতান্ত্রিক ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য এর বিকাশে প্রতিবন্ধক। এর বিকাশে লাল, নীল, সবুজসহ নানা রং ও বর্ণের প্রয়োজন হয়। পর্যটন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিল্প, একা বড় অসহায়। সবাই মিললে অনেক শক্তি সঞ্চার করে এবং প্রচুর মানুষের জীবন পাল্টে দেয়। বাংলাদেশ বড্ডো বেশি ডমেস্টিক ট্যুরিজম নির্ভর। এবং সেটি নিয়ন্ত্রণহীন।
আজকে টেকসই ও স্থিতিস্থাপক পর্যটন কাম্য, যা অর্থনীতির বিকাশ এবং জটিল বিষয়গুলো বহুপক্ষীয় সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান খোঁজে। দেশি পর্যটক আমাদের সম্পদ, কিন্তু প্রকৃতি রক্ষায় তাতে রাশ টানতে হবে। যেমন—সেন্ট মার্টিন রক্ষায় করা হয়েছে। টেকসই পর্যটন বিকাশে দেশি ও বিদেশি পর্যটক দুটিকেই সামনে রাখতে হবে। সামলাতে হবে যথার্থভাবে।
আমাদের পর্যটন প্রধানত প্রকৃতিনির্ভর। ফলে অবারিতভাবে যার যেমন খুশি বেড়ানো নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। বিদেশি পর্যটক আনার ক্ষেত্রে আমরা বড্ডো লাজুক। এর কারণ স্পষ্ট নয় এবং নানা ক্ষেত্রে পদে পদে বাধা। সেগুলো অপসারণে সমন্বিত প্রচেষ্টা নেই। ফলে যাঁরা বিদেশি পর্যটক আনেন, তাঁরা সব সময় এক অনিশ্চয়তায় ভোগেন। পর্যটন খাতে যেকোনো দেশ প্রধানত গুরুত্ব দেয় বিদেশি পর্যটককে কেন্দ্র করে। আমরা তার বিপরীতমুখী। ফলে আমাদের পর্যটনপণ্য আজও বৈশিক হচ্ছে না। এসব বিষয়ে ব্যাপক সংস্কার, নিয়ন্ত্রণ ও গতিশীল করা দরকার।
আজকের দিনে আধুনিক পর্যটন সহনশীল ও টেকসই হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিল্পের বিকাশ নেই, কিন্তু অসংখ্য অ্যাসোসিয়েশন/সমিতির ছড়াছড়ি। সবাই নেতা হতে চান। শিল্পে তাঁদের অবদান বা জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন থাকে। ট্যুরিজম বোর্ড তাঁদের কবজায়। ফলে পর্যটনের বিকাশ দিকনির্দেশহীন। পর্যটনশিল্পের ক্ষেত্রে যে অস্থিরতা বিরাজমান, এটি তারই লক্ষণ। পর্যটনপণ্য নিরূপণ করা, সে অনুযায়ী পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। যে কেউ যেমন-তেমন করে রিসোর্ট বানাচ্ছেন। সেবার মান, পণ্যের মান, কোনো কিছুর ঠিক-ঠিকানা নেই, কিন্তু উচ্চমূল্য। অথচ বাংলাদেশ এক অসাধারণ গন্তব্য। আমাদের আছে নদী, সমুদ্র, পাহাড়, চা-বাগান, ঐতিহ্য, মুসলিম-বৌদ্ধ-হিন্দু উপাসনালয়, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, উপজাতি এবং নানা সংস্কৃতির মেলবন্ধন, কৃষি ইত্যাদি। বিদেশিদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এসব পর্যটন উপযোগী উপাদান যথেষ্ট। শুধু নেই পদক্ষেপ, প্রচার, বাজারজাতকরণ।
ড. ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব যথার্থ হবে বাংলাদেশের পর্যটন বিকাশের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে সামাজিক ব্যবসার বিকাশেও পর্যটন পারে বিশেষ অবদান রাখতে। বিশ্বে পর্যটন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অনন্য। ১০ কর্মের একটি পর্যটন এবং গ্লোবাল জিডিপিতে ৯ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশে তিনের কাছাকাছি। খাতটি পরিবেশবান্ধব। ধূম্রবিহীন শিল্প হিসেবে দেখা হয় পর্যটনকে। বাংলাদেশে এই খাতটি নিয়ে একটি যথাযথ মহাপরিকল্পনা এ ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। এটিই যথার্থ সময় বিষয়টি নিয়ে ভাবার এবং পদক্ষেপ নেওয়ার। কারণ ইউনূসের দেশে ইউনূসের তত্ত্বের ভিত্তিতে পর্যটনের বিকাশ হচ্ছে—এই সংবাদ যথেষ্ট বিদেশিদের আকর্ষণ করা। অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যটন উন্নয়নে সব অংশীজন, স্থানীয় সম্প্রদায়, ব্যবসায়ী এবং পর্যটক যেন এই শিল্পে অংশগ্রহণ করতে পারে।
পর্যটনসম্পদ ব্যবহারে সচেতনতা এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে পর্যটক ও স্থানীয় লোকজন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংশীজন। কয়েক বছর ধরে শুনে আসছি, বাংলাদেশ ই-ভিসার যুগে প্রবেশ করছে। আজও তা অধরা থেকে যাচ্ছে। নাম না জানা অনেক দেশ ই-ভিসা চালু করেছে। আমাদের আর কত সময় লাগবে, জানতে চাই। মনে রাখতে হবে, ই-ভিসা এক অনন্য হাতিয়ার বিদেশি পর্যটক আনতে। নতুন এয়ারপোর্ট খোলার পরে যে যাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধির আশা আমরা করছি, তার জন্য ই-ভিসার বড় ভূমিকা থাকবে।
একটি কথা না বললেই নয়। বহু উচ্চারিত, বহু চর্চিত। বাজারজাতকরণ। একটি শব্দ কিন্তু বহুমাতৃক। ব্যাপক তার বিস্তার। কিন্তু সরকার তার বাজেটে এই বিষয় উপেক্ষা করে। ফলে নাক ভাসিয়ে বাঁচছে পর্যটন। কথিত আছে, আপনি এক ডলার খরচ করলে ১০ ডলার উপার্জন করতে পারবেন। ভ্রমণকর থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা উপার্জন হচ্ছে। পর্যটন উন্নয়ন ও বাজারজাতকরণে অন্তত পক্ষে দুই হাজার কোটি বরাদ্দ দিন। দেশের বিদেশি মুদ্রা অর্জন, ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং সর্বোপরি ড. ইউনূসের দেশের মানুষ কেমন অতিথিপরায়ণ, তা বিশ্বকে তুলে ধরেন।