সংকটে ইনবাউন্ড ট্যুরিজম : উত্তরণে করণীয়
এখন পর্যটনের ভরা মৌসুম। বাংলাদেশে সাধারণতঃ অক্টোবর থেকে মার্চ অব্দিই পর্যটন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কি অভ্যন্তরীণ, কি আন্তর্জাতিক। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ পর্যটন যথেষ্ট ভালো চললেও চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দেশের ইনবাউন্ড পর্যটন। অথচ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত ইনবাউন্ড ট্যুর অপারেটরের ট্যুর বুকিং প্রায় শতভাগ নিশ্চিত ছিলো। একটি দেশের ট্যুরিজম বিশেষতঃ ইনবাউন্ড ট্যুরিজম পুরোপুরি নির্ভর করে, সে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্তিতি এবং সঠিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির ওপর।
গত আগষ্টে পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর দেশ জুড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি টাল মাটাল হয়ে যায়। দেশ জুড়ে বিশৃংখলা, আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি, ভাঙ্গচুর, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকান্ড-সব মিলিয়ে চরম দুরাবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে দেশ জুড়ে সংঘটিত এইসব সংবাদ, দেশের গন্ডী পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষতঃ আন্তর্জাতিক ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। ফলে আমাদের দেশে ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটকদের উৎসাহে যথেষ্ট ভাটা পরে। এমনিতেই বাংলাদেশ আমাদের প্রতিবেশী পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় পর্যটক সমৃদ্ধ দেশ নয়। পর্যটকদের আকর্ষণ করবার জন্যে যথেষ্ঠ ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং কিংবা মার্কেটিং ও প্রমোশনের কাজগুলো বিগত বছরগুলোতে সঠিক ভাবে করা হয় নাই -এ কথা মানতেই হবে। অথচ এই সময়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান -যার কিনা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অত্যন্ত নেতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। সেই পাকিস্তানে গত কয়েক বছরে নিয়মিতভাবে প্রচুর শুধুমাত্র বেড়াতে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। অথচ পত্র-পত্রিকা আর সামাজিক মাধ্যমে দেখি প্রতিনিয়ত ওখানে বোমা বিস্ফোরন আর মৃত্যুর খবর। তারপরেও এডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের ভীড় পাকিস্তানে। আমাদের প্রতিবেশী নেপাল আর শ্রীলংকার পর্যটনের বর্তমান অবস্থার কথা আর নাই বা বললাম।
শ্রীলংকা তো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁদের অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের বেড়াজাল ছিড়েঁ অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়েছে। ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত শ্রীলংকায় গিয়েছে প্রায় পনেরো লক্ষের ওপর বিদেশী পর্যটক। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আগত পর্যটকের সংখ্যাও কম নয়। তারমানে বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের উপযুক্ত ব্র্যান্ডিং, মার্কেটিং, প্রমোশন যেমন নেই তার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে আমাদের বিকাশমান পর্যটন শিল্প বিশেষতঃ ইন বাউন্ড পর্যটন ধ্বংসের পথে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি। একটা উত্তরণের পথ হচ্ছে, বিদেশে বিশেষতঃ আমাদের পর্যটনের ট্যুরিষ্ট জেনারেটিং কান্ট্রিস অথবা সোর্স মার্কেটে বেশী বেশী মার্কেটিং, প্রমোশন এবং রোড শো’র আয়োজন করা। বিভিন্ন দেশের ট্যুর অপারেটর, পর্যটন সাংবাদিক ও পর্যটন লেখক এবং পর্যটন ব্লগারদের সমস্ত খরচ বহন করে দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্থানে নিয়ে সচক্ষে দেখানোর ব্যবস্থা করা, যাতে তাঁরা স্ব-স্ব দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক লেখনীর মধ্য দিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা সে দেশগুলোর পাঠকদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন।
কিন্তু ইনবাউন্ড পর্যটনের এই মুহুর্তের বার্নিং ইস্যু হচ্ছে, বিভিন্ন দেশগুলো কর্তৃক বাংলাদেশের ব্যাপারে রাজনৈতিক এবং সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় ট্রাভেল এডভাইজারী প্রয়োগ। অর্থাৎ একটি দেশ সাধারণতঃ তাঁর জনগণকে অন্য কোনো দেশে ভ্রমণের পূর্বে পর্যটন সতর্কবার্তা প্রদান করে। সেখানে উল্লেখ থাকে, ঐ সমস্ত দেশের কিছু বাস্তব অবস্থার বর্ণনা এবং ঐ সমস্ত দেশে ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনায় লেভেল ওয়ান, টু, থ্রি কিংবা কোনো ক্ষেত্রে রেড এলার্ডের কথা উল্লেখ থাকে। বিদেশী পর্যটকরা ঐ সমস্ত ট্রাভেল এডভাইজারীকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে ঐ সমস্ত দেশ ভ্রমণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ইউরোপের প্রধান প্রধান দেশগুলো যেমনঃ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলো বাংলাদেশের ব্যাপারে লেভেল থ্রি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেড এলার্ডের কথা উল্লেখ করেছে তাদের ট্রাভেল এডভাইজারীতে। ফলশ্রুতিতে, মার্চ পর্যন্ত ইনবাউন্ড ট্যুর অপারেটরদের প্রায় ৮০ শতাংশ ট্যুর ইতোমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে। এ অবস্থা ট্যুর অপারেটরদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক তারকা মানের হোটেলগুলোতেও।
সুতরাং এই মুহুর্তে পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং পর্যটন বোর্ডের প্রধানতম কর্তব্য হচ্ছে, দেশে অবস্থিত সোর্স মার্কেটের দেশগুলোতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশের পর্যটনের ইতিবাচক উপস্থাপনা প্রদান করা। পাশাপাশি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস, হাই কমিশনকে পর্যটনের উন্নয়নের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা -যার আলোকে দূতাবাসগুলো নিয়মিতভাবে ঐ সমস্ত দেশের পর্যটন লেখক, ট্যুর অপারেটর, পর্যটন সাংবাদিক, পর্যটন ব্লগারদের নিয়ে ট্রাভেল আপডেট উপস্থাপন করে। এর পাশাপাশি ছোট ছোট আয়োজন যেমনঃ দেশীয় খাদ্য, হস্ত ও কুটির শিল্প এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তাঁদের মনোযোগের চেষ্টা করে। দূতাবাসগুলোতে ভিসা প্রত্যাসীদের ভিসার পাশাপাশি পর্যাপ্ত সংখ্যক পর্যটনের লিফলেট, ব্রুসিয়র, ম্যাপ এবং আকর্ষনীয় পর্যটন স্থানের ছবি সম্বলিত এলবাম এবং পোষ্টার প্রদান করতে হবে। এছাড়াও সোসাল মিডিয়াতে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন খবর ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক জনসংযোগ সংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কাজ করতে হবে। এছাড়াও আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি, পর্যটনের উন্নয়নের জন্যে আমাদের ই-ভিসা প্রবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান আর শ্রীলংকা ই-ভিসার প্রবর্তন করে আশাতীত সাফল্য পেয়েছে।
সুতরাং নতুন পরিবর্তিত সময়ে নতুন এবং ইতিবাচকভাবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করে বিদেশী পর্যটকদের বাংলাদেশমুখী করা এখন সময়ের দাবী। আর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে কিংবা নতুন নতুন কর্মস্থান সৃষ্টিতে পর্যটনের কোনোই বিকল্প নেই । দেশটা যেহেতু নতুন ভাবে গড়া হচ্ছে, আসুন না সকলে মিলে পর্যটন শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইতিবাচক ভাবমূর্তির দেশ হিসেবে উপস্থাপিত করে দারিদ্র বিমোচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখি।