আগামীর পর্যটন মন্ত্রী সমীপে
আন্তর্জাতিক পর্যটনে খুব খারাপ সময় পার করছে বাংলাদেশ। এমনিতেই করোনার প্রভাবে পর্যটন শিল্প এখনও আগের অবস্থাতে ফেরেনি। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে তাদের পর্যটনের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দু’টো দেশ শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ ইতিমধ্যে ২০২৩ সালে যথাক্রমে ১৫ লক্ষ এবং ১৮ লক্ষ বিদেশী পর্যটকের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ফেলেছে। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশের বিদেশী পর্যটক আগমনের সংখ্যা জানা যায়নি। দীর্ঘদিনের পর্যটন অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করি কেনো যেনো সরকারের পর্যটন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও বিদেশী পর্যটক আনার ক্ষেত্রে খুব বেশী আগ্রহী না, যতটা না অভ্যন্তরীণ পর্যটনের ব্যাপারে। অভ্যন্তরীণ পর্যটনতো লাগবেই। দেশের মানুষের ভেতর দেশপ্রেম জাগ্রতকরণে কিংবা দেশীয় পর্যটন সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করবার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে উৎসাহ এবং সুযোগ-সুবিধাদি বৃদ্ধি করতেই হবে। শুধু তাই নয় দেশের সাধারণ মানুষজনকেও পর্যটনের গুরুত্ব বোঝাতে সচেতনামূলক বিভিন্ন কর্মসূচীও হাতে নেয়া প্রয়োজন -যাতে সাধারণ মানুষজন এর গুরুত্ব বুঝে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ইনবাউন্ড ট্যুরিজম অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পর্যটন নিয়ে। বিদেশী পর্যটক
-যারা শুধুই বেড়ানোর জন্যেই একটি দেশে যায়, তারা আসছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনার কিংবা এনআরবি -যারা বিদেশী পাসপোর্টধারী বাংলাদেশী, তাঁদেরও বিদেশী পর্যটক বলে চালিয়ে দিচ্ছি আমরা। এছাড়াও পর্যটকদের কোনো ধরনের পরিসংখ্যাণও আমাদের নেই। কোন কোন প্রধান প্রধান দেশ থেকে বিদেশী পর্যটকরা আসে, তাঁদের সংখ্যা কত, তাঁদের গড় ব্যয় কত, তাঁরা কমপক্ষে কতদিন দেশে থাকে ইত্যাদি তথ্যগুলো ছাড়া কখনো একটি কার্যকরী বিপনন্ কার্যক্রম পরিচালনা প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই সব তথ্যগুলো জানার বা জানানোর কোনো সরাসরি প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় না।
মার্কেটিং ও প্রমোশনেও অনেক বড় ধরনের ঘাটতি দেখি। এ্যামেজিং থাইল্যান্ড বা ট্রুলি এশিয়া কিংবা ইনক্রিডিবল ইন্ডিয়া-র লোগো এবং ব্র্যান্ডিং সারা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ্য করি। কি যানবাহনের গায়ে, কি বিজ্ঞাপনে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায়। কিন্তু আমাদের দেশের কোনো ব্র্যান্ডিং বিদেশের কোনো গণ-মাধ্যমে কখনোই লক্ষ্য করি নাই। এ ব্যাপারে বাজেট বরাদ্দও খুবই অল্প। সম্প্রতি আবার বিদেশের বিভিন্ন পর্যটন মেলায় অংশগ্রহণও বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ পর্যটনের বিশ্ব মানচিত্র থেকে একপ্রকার নির্বাসিতই বাংলাদেশ।
আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, যেহেতু পর্যটনশিল্প সরাসরি আরও অনেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত, তাই আন্তঃমন্ত্রণালয় সু-সম্পর্কও এক্ষেত্রে বেশী জরুরী -যেটির ব্যাপক কমতি লক্ষ্য করি আমরা। পর্যটন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অনেক সময়ই অগ্রাধিকার কিংবা নিজস্ব বলে মনে করে না অন্যান্য সংস্থাগুলো। যেমন: ভিসার কথা বললে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়, বিদেশী মিশনগুলো বললে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নদী পর্যটন নিযে কথা বললে নৌ-মন্ত্রণালয়, স্থাপত্য ও পুরাকীর্তি নিয়ে কথা বললে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, স্পোটর্স ট্যুরিজম নিয়ে কথা বললে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ইত্যাদি ইত্যাদি সংস্থাগুলো রয়েছে। সমস্যা হলো, এদের কারো কাছেই পর্যটন অগ্রাধিকার প্রাপ্ত শিল্প নয়। যদিও বিশ্বব্যাপি পর্যটন শিল্পের জিডিপিতে আয় প্রায় ১০ শতাংশ, পর্যটনে বিনিয়োগ প্রায় ৯.৪ শতাংশ, কর্মসংস্থানে প্রায় ৮.২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপি প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছে। এতসব পরিসংখানের পরও আমাদের দেশে পর্যটন অগ্রাধিকার প্রাপ্ত শিল্প নয়।
বিগত সময়গুলোতে সকলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি, পর্যটন শিল্পে আগত মন্ত্রী মহোদয়েরা এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে খুব ইতিবাচক কোনো কিছু করতে পেরেছেন বলে বেসরকারী পর্যটন সংস্থার একজন মাঠ পর্যায়ের কর্মী হিসেবে মনে হয়নি। আমাদের দরকার ছিলো একজন কম বয়স্ক তরুণ মন্ত্রীর -যিনি নিজ প্রজ্ঞা ও মেধায় আমাদের শিল্পকে শানিত করবেন। যিনি ছুটে বেড়াবেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। সরকারী সংশ্লিষ্টজনদের সাথে মতৈক্যে পৌঁছুবেন। আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নে একসাথে কাজ করবেন। এছাড়াও বেসরকারী অংশীজনদের সাথে দফায় দফায় সভা করে একটি ভবিষ্যৎ কর্ম-পরিকল্পনা তৈরী করবেন। দেশী-বিদেশী মিশনগুলোর সাথে সুসম্পর্ক তৈরী করবেন। সর্বোপরি দেশের প্রধানমন্ত্রী -যিনি সরকার প্রধান তাকে এই শিল্পের প্রধান উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করতে বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা নেবেন।
আমরা আমাদের বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখেছি পৃথিবীর অনেক দেশেই পর্যটন কর্মকান্ড পরিচালিত হয়, সে দেশের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথীর মোহাম্মদ কিংবা সিঙ্গাপুর কিংবা মালদ্বীপের দিকে তাকালেই আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাই।
সামনেই আমাদের জাতীয় নির্বাচন। সুতরাং আগামীর পর্যটনমন্ত্রীর জন্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়, দপ্তর, সংস্থাগুলোকে এক সূতাঁয় গেঁথে বেসরকারী সংস্থাসমূহকে নিয়ে একটি সার্বজনীন পর্যটন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা -যাতে সরকারী-বেসরকারী সকলেই অংশ নিতে পারে। এছাড়াও আগামীর পর্যটনমন্ত্রী একজন বেসরকারী পর্যটনবান্ধব মানুষ হবেন, এ আশা করা অমূলক নয়।
আচ্ছা, বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট একজন যদি বাণিজ্য মন্ত্রী হতে পারেন তবে পর্যটনে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন কি আগামীর পর্যটনমন্ত্রী হতে পারে না?
Image Source: The Finance Today